মানবসেবার ক্ষেত্রে এক নতুন ইতিহাস লিখছেন মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘীর জগদল গ্রামের সঞ্জীব দাস। পেশায় তিনি সাধারণ একজন মানুষ হলেও, তাঁর হৃদয়ের ভিতর লুকিয়ে আছে অসাধারণ এক মানবিক শক্তি। আজ তিনি পরিচিত হয়েছেন রক্তযোদ্ধা হিসেবে— যার কাছে রক্তদান শুধু একটি কাজ নয়, বরং এক আজীবন প্রতিজ্ঞা।
এক যাত্রার শুরু
আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে সঞ্জীবের মাথায় আসে এক বিশেষ ভাবনা— “মানুষের পাশে দাঁড়ানোই জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ”। সেই বিশ্বাস থেকেই কয়েকজন সমমনা যুবককে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সমাজসেবী সংগঠন। মূল লক্ষ্য ছিল মানবসেবা, আর তারই প্রথম অধ্যায় শুরু হয় রক্তদান কর্মসূচি দিয়ে।
নিজের জন্মদিনকে সাধারণ আনন্দের দিনে সীমাবদ্ধ না রেখে, সঞ্জীব তা রূপ দেন অন্যরকম এক উৎসবে। আয়োজন করেন একটি রক্তদান শিবির। মানুষের সাড়া দেখে তিনি বুঝতে পারেন, এটাই তাঁর পথ। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি। বুঝতে পারেন, অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দিনের বেলায় চাকরি বা কাজের কারণে রক্তদান করতে পারেন না। তাঁদের কথা ভেবেই তিনি প্রথমবারের মতো সন্ধ্যাকালীন রক্তদান শিবির আয়োজন করেন। এই উদ্যোগ সাগরদিঘী ও আশেপাশের এলাকায় নতুন এক ধারা তৈরি করে।

মানবসেবায় নতুন দিশা
শুধু জন্মদিন নয়, এখন সাগরদিঘীর নানা প্রান্তে দেখা যায়— পূজো, বিবাহবার্ষিকী বা যেকোনো আনন্দঘন অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রক্তদান শিবির। মানুষ উপলব্ধি করেছেন, রক্তদানও হতে পারে উদযাপনের এক মহৎ মাধ্যম। আর এই ভাবনার মূল কারিগর সঞ্জীব দাস।
আজ শুধু সাগরদিঘী নয়, জেলার বহু জায়গায় রক্তের প্রয়োজন পড়লে প্রথমেই যে নামটি উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন সঞ্জীব। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মুমূর্ষু রোগীর পাশে দাঁড়ান তিনি। কখনও নিজের রক্ত দিয়ে, কখনও বা নতুন রক্তদাতা খুঁজে এনে। ধীরে ধীরে তিনি সাগরদিঘীতে গড়ে তুলেছেন এক শক্তিশালী রক্তদাতা নেটওয়ার্ক। তাঁর স্বপ্ন— প্রতিটি পরিবার থেকে অন্তত একজন রক্তদাতা তৈরি করা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর এগিয়েও গেছেন তিনি।

সঞ্জীবের ভাবনা
সঞ্জীব দাস বলেন—
“আমি সবসময় একটা জিনিস মাথায় রেখে কাজ করি— যেন রক্তের অভাবে কোনো রোগীকে মারা যেতে না হয়। আমার নিজের চোখে অনেক পরিবারকে কাঁদতে দেখেছি, শুধু এক ব্যাগ রক্তের জন্য। তাই প্রতিজ্ঞা করেছি, যতদিন বাঁচবো ততদিন রক্তদানের মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়াবো।”
তিনি আরও বলেন—
“এই কাজ করতে করতেই আমি অনেক নতুন রক্তদাতা তৈরি করতে পেরেছি। এখনো ব্লাডব্যাঙ্কগুলিতে রক্তের অভাব দেখা যায়, আর সেটাকে কম করাই আমার লক্ষ্য। মানুষের সহযোগিতা থাকলে এই কাজ আরও বড় আকারে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।”

অনুপ্রেরণার প্রতীক
সঞ্জীব দাসের এই উদ্যোগ শুধু জীবন বাঁচাচ্ছে না, বদলে দিচ্ছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও। মানুষ এখন বুঝতে শিখছে— রক্তদান শুধু প্রয়োজনের সময় নয়, বরং এক নিয়মিত দায়িত্ব। তাঁর প্রচেষ্টায় সাগরদিঘীর মানুষ শিখেছে, এক ব্যাগ রক্ত মানেই একটি নতুন জীবন, একটি পরিবারের মুখে আবারো হাসি ফোটানো।
আজ অনেক তরুণ-তরুণী সঞ্জীবের দেখানো পথে হেঁটে রক্তদাতা হিসেবে এগিয়ে আসছেন। তাঁর গল্প গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক পরিবারে যেভাবে আগে অন্তত একজন শিক্ষক বা ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা হতো, এখন সেভাবেই মানুষ ভাবতে শুরু করেছে— “আমাদের বাড়ি থেকেও একজন রক্তদাতা থাকতে হবে।”

সত্যিই, সঞ্জীব দাস শুধু একজন রক্তদাতা নন, তিনি এক আন্দোলনের অগ্রদূত। তাঁর প্রতিটি প্রচেষ্টা প্রমাণ করে— ছোট্ট একটি গ্রামের সাধারণ মানুষও সমাজে বড় পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।
রক্তদান শুধু জীবন বাঁচায় না, রক্তদানের মতো উদ্যোগ সমাজে ছড়িয়ে দেয় একতা, মানবতা আর আশার আলো। আর সেই আলোই আজ দীপ্তি ছড়াচ্ছে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘীতে, এক মানুষ— সঞ্জীব দাসের হাত ধরে।
